বিগত আট বছরে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা প্রকৃত মুনাফা করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। পরিসংখ্যান বলছে, বিপিসি ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের মে পর্যন্ত কোনো বছরই জ্বালানি তেল বেচে লোকসান দেয়নি। এ সময়ে প্রকৃত মুনাফা হয়েছে ৪৮ হাজার ১২২ কোটি ১১ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের মে পর্যন্ত ১১ মাসে তেল বিক্রি করে প্রকৃত মুনাফা হয় এক হাজার ২৬৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। নয়া দিগন্তে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
এখন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম সাময়িকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপিসি লোকসান গুনছে- এ অজুহাতে দাম বাড়ানোর জন্য জ্বালানি বিভাগ থেকে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে সরকারের কাছে। আগামী জুলাই মাসে তেলের দাম আবার বাড়তে পারে। এর আগে হাজার কোটি টাকা লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে ৩ নভেম্বর ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়ানো হয়। যার কারণে পরিবহন খরচ বাড়ে, বেশির ভাগ জিনিসপত্রের দামও বেড়ে যায়।
বিপিসি সূত্র মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি চাপে পড়েছে। প্রতিদিন প্রতিষ্ঠানটির প্রায় শতকোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। কিন্তু এতে তেমন কোনো সমস্যা হতো না যদি নিজস্ব রিজার্ভে পর্যাপ্ত অর্থ থাকত। বিপিসির রিজার্ভে থাকা প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়ের চাহিদামাফিক দিয়ে দেয়া হয়েছে। একটি আইনের বলে এই উদ্বৃত্ত অর্থ দিতে হয়। অন্য দিকে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে কিছু অবকাঠামো নির্মাণ করতে গিয়ে বিপিসিকে বিপুল অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। এর মধ্যে পদ্মা অয়েলের নামে ঢাকার শাহবাগে ৩৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ১২তলা একটি আবাসিক ভবন নির্মাণ। চট্টগ্রামেও একই ধরনের বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে লোকসানের অর্থ পূরণের কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। এমন পরিস্থিতিতে হয় তেলের দাম বাড়াতে হবে, না হলে ভর্তুকি করতে হবে দ্বিগুণ।
লক্ষণীয়, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে, তখন দেশে দাম সমন্বয় (হ্রাস) করা হয় না। অন্য দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়তে থাকলেই বিপিসির লোকসানের অজুহাতে দাম সমন্বয়ের (বৃদ্ধি) সুপারিশ করা হয় জ্বালানি বিভাগ থেকে। এবারো এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না; ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের দাম আরেক দফা বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। এ বিষয়ে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ক্রমান্বয়ে তেল, গ্যাস, সার ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে। তবে তা ভোক্তাদের সহনীয় পর্যায়ে রাখা হবে। গত সপ্তাহেও তিনি বলেছেন, তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। ভোক্তাদের যাতে তেমন কোনো অসুবিধা না হয়; বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
আমাদের সবার জানা, যেকোনো জ্বালানির দাম বেড়ে গেলে এর চক্রাকার প্রভাব নাগরিক জীবনের নানা ক্ষেত্রে পড়তে বাধ্য। বিশেষ করে ডিজেলের দাম বাড়লে পণ্য পরিবহন ব্যয় বেড়ে যায়। যার প্রভাবে প্রতিটি জিনিসের দাম বাড়ে। ফলে অবধারিতভাবে বেড়ে যায় মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও। এ জন্য প্রত্যেকটি রাষ্ট্র নাগরিকদের জীবনমান ঠিক রাখতে জ্বালানির দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে গভীরভাবে ভেবে পদক্ষেপ নেয়; কিন্তু আমাদের দেশে নাগরিক দুর্ভোগ বাড়তে পারে সে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয় না বললেই চলে। বেশির ভাগ সময় সরকার জনগণের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি দায় বোধ করে না। এর কারণ বিগত দু’টি নির্বাচনে জনগণের মতামতের কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। ফলে সরকার জনস্বার্থের দিকটি তেমন ভাবছে বলে মনে হয় না। এতে করে উপেক্ষিত থেকে গেছে জনস্বার্থ। এত কিছুর পরও আমরা আশা করতে চাই, তেলের দাম বাড়িয়ে বিপিসির অবিবেচনাপ্রসূত ব্যয়ের বোঝা যেন জনগণের কাঁধে চাপানো হবে না।