বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের লক্ষ্যে গতকাল সোমবার রাত ৮টার পর সারা দেশে দোকান, মার্কেট, শপিংমল বন্ধ রাখার নির্দেশ কার্যকর হয়েছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ব্যবসায় সংগঠনের প্রতিনিধি, বিভিন্ন ব্যবসায়ী মালিক সংগঠন এবং শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী জ্বালানির অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধিজনিত বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের নিমিত্তে এই সিদ্ধান্ত।
দুই বছর আগে কোভিড-১৯ মহামারী শুরুর সময় থেকে অর্থনীতি একের পর এক ধাক্কা সামলেছে। এ মুহূর্তে ইউরোপে একটি যুদ্ধ চলছে। পাশাপাশি দেশে বড় ধরনের বন্যা দেখা দিয়েছে। এসবই অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি শ্লথ করছে। একই সাথে বিভিন্ন মেগা উন্নয়ন প্রকল্পে অস্বাভাবিক উচ্চব্যয়ও বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে তাতে সন্দেহ নেই। এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতি এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠেছে।
এ পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই। এ কারণে রাত ৮টার পর দোকান, বিপণিবিতান, মার্কেট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত সময়োচিত ও যথার্থ। তবে এতে সত্যিই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি কতটা সাশ্রয় হবে সেটি খতিয়ে দেখার দরকার আছে। দরকার আছে বিষয়টি যথাযথভাবে নজরদারি করার। কারণ কোরবানির ঈদ আসন্ন। বছরের দুটি বড় উৎসব ঈদ সামনে রেখে মানুষের কেনাকাটা বাড়ে, আর্থিক লেনদেন বাড়ে। ঈদে ব্যবসায়ীদের বছরের সর্বোচ্চ বিক্রিবাট্টা হয়। বিপুল পরিমাণ বিপণন ও আর্থিক লেনদেন অর্থনীতিকে সচল করে। রাত ৮টায় দোকানপাট, মার্কেট বন্ধ রাখায় সার্বিকভাবে কতটা ক্ষতি হবে সেটি নিরূপণ করা জরুরি। কারণ, জ্বালানি সাশ্রয়ের বিষয়টি বাস্তবিকই যদি ব্যয় অনুপাতে লাভজনক (কস্ট-ইফেক্টিভ) না হয়; তাহলে অযথা ব্যবসায়ীদের ক্ষতির মধ্যে ফেলাটা হবে অর্থহীন।
সাশ্রয়ের বিষয়টি খন্ডিতভাবে দেখার সুযোগ নেই। জ্বালানি খাতে বর্তমান সরকার যতটা গুরুত্ব দিয়েছে, এর আগে কোনো সরকারই তা দেয়নি। বলা হচ্ছে, দেশের চাহিদার চেয়েও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা এরই মধ্যে অর্জন করেছে দেশ। প্রতি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর ঘোষণাও দেয়া হয় ঘটা করে। কিন্তু এ জন্য যে আর্থিক বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে তার কার্যকর সুফল কতটা পাওয়া যাচ্ছে সেটাও দেখতে হবে। জ্বালানির একটি বড় অনুষঙ্গ গ্যাস। গ্যাস অনুসন্ধান ও বিদ্যমান কূপগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবহেলা ও অমনোযোগের অভিযোগ আছে। প্রকৃত করণীয় উপেক্ষা করে সংশ্লিষ্টরা বিপুল বাড়তি অর্থ ব্যয়ে এলএনজি আমদানির ব্যাপারেই কেন বেশি আগ্রহী এমন প্রশ্নও তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাত ৮টায় সব মার্কেট ও দোকানপাট বন্ধ হলে এর পরপরই পরিবহনের ওপর চাপ পড়বে এবং যানজট সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। তেমন হলে পরিবহন খাতে জ্বালানির সাশ্রয় না হয়ে উল্টোটা হতে পারে। সরকারি গাড়ির ব্যবহারসহ জ্বালানি সাশ্রয়ের আরো কী কী উপায় গ্রহণ করা যায় সেটাও ভেবে দেখা দরকার বলে মত দিয়েছেন অনেকে। দোকান মালিক সমিতি সকাল ১০টার বদলে দুপুর ১২টায় মার্কেট খোলা এবং রাত ৯-১০টা পর্যন্ত চালানোর প্রস্তাব দিয়েছে। আমাদের ধারণা, এসব মতামত ও প্রস্তাব ভেবে দেখা যেতে পারে।
বিশে^র অনেক দেশেই রাত ৮টার পর দোকানপাট মার্কেট খোলা রাখা হয় না। আমাদের মতো নাজুক অর্থনীতির দেশে অনেক আগেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল। দেরিতে হলেও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং তা কার্যকরও হচ্ছে। এটা সমর্থন না করার কোনো কারণ নেই। তবে, আমরা মনে করি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের নামে যেন এককভাবে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন তা-ও নিশ্চিত করতে হবে।